ভূত ধরা পড়িয়াছে, এই কথা চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। ভূত দেখিবার মানসে নানা স্থান হইতে নানা লোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইতে লাগিল। কেহ বা সাহসে ভর করিয়া উহার নিকটে গিয়া উহাকে দর্শন করিল, কেহ বা দূর হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল। কাহারও সে সাহসও হইল না, অপরে যাহা দেখিয়াছে, তাহাই শুনিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল।
হানিফ খাঁর সহিত অপর যে তিন ব্যক্তি ধরা পড়িয়াছিল, তাহারা পরিশেষে আত্ম-পরিচয় প্রদান করিল। তাহারা কে, কোথায় তাহাদিগের বাড়ী, তাহাও বলিল। ডাকাইতি করিয়াই যে তাহারা জীবনধারণ করে, তাহাও তাহারা স্বীকার করিল, এবং যে যে স্থানে তাহারা ডকাইতি করিয়াছে, তাহাও বলিয়া দিল। আরও কহিল, তাহারা তিন জনেই সর্দ্দার হানিফ খাঁর প্রিয় শিষ্য, সেই জন্য তাহারা প্রায়ই হানিফ খাঁর নিকট অবস্থান করিয়া থাকে।
ঐ স্ত্রীলোকটী যে কে, সে কথাও প্রকাশ হইয়া পড়িল। সে বহুদিবস হইতে হানিফ খাঁর আশ্রিত। হানিফ খাঁও তাহাকে প্রণের সহিত ভালবাসে, যেখানে যায়, সেই স্থানেই তাহাকে সঙ্গে লইয়া যায়। সেই জন্যই এই নির্জ্জন বাসেও সে হানিফ খাঁর সহচরী।
হানিফ খাঁ প্রথম প্রথম তাহার নিজের পরিচয় গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু পরিশেষে যখন সে দেখিল যে, তাহার সমস্ত কথা ক্রমে প্রকাশ হইয়া পড়িতেছে, তখন সমস্তই স্বীকার করিল। স্বীকার করিল, তাহারই নাম হানিফ খাঁ, সেই পূর্ব্বে ধৃত হইয়া ফাঁসির হুকুম প্রাপ্ত হয়।
সর্ব্ব সমক্ষেই তাহাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলান হইয়াছিল, কিন্তু যে জল্লাদ তাহার গলায় দড়ি পড়াইয়া দেয়, সে তাহার দলভুক্ত একজন ডাকাইত ছিল, সে ঐ দড়িতে এরূপভাবে একটী গাঁট দিয়া রাখিয়াছিল যে, গলায় দড়ি দিয়া সজোরে উচ্চ হইতে পতিত হইলেও ঐ দড়ির ফাঁস গলায় আঁটিয়া যায় নাই। যে সময় সে ফাঁসি মঞ্চের উপর হইতে ঝুলিয়া পড়ে, সেই সময় জল্লাদ ঐ মঞ্চের ভিতরেই দাঁড়াইয়া ছিল, পড়িবার সময় সে নিচে হইতে উহাকে ধরে, তাই গলায় ফাঁস আঁটিয়া যায় নাই বা বিশেষরূপ সে আঘাত প্রাপ্ত হয় নাই; কেবল কিছুক্ষণ ঝুলিয়া থাকে মাত্র। অল্পক্ষণ পরে সুযোগ মত ঐ জল্লাদ তাহাকে ঐ রজ্জুর ফাঁস হইতে নামাইয়া, নিজের ঘরে লুকাইয়া রাখে, রাত্রিকালে কোন গতিকে জেলের ভিতর হইতে বাহির করিয়া দেয়। এইরূপে সে যাত্রা সেই জল্লাদ তাহার জীবন রক্ষা করে। সে মরে নাই বা ভূতও হয় নাই, তবে লোকদিগকে ভয় দেখাইবার নিমিত্ত সে ভূত সাজিয়া বেড়াইত, এই জন্যই লোকে জানিত যে, হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে; সুতরাং কেহই তাহার নিকটে আসিতে সাহস করিত না।
এই সমস্ত বিষয় অবগত হইবার পর হানিফ খাঁর পুনরায় বিচার হইল। তথায় ভূতের বিষয় দেখিবার নিমিত্ত অনেক লোকের আগমন হইল। যে জজসাহেব পূর্ব্বে হানিফ খাঁর বিচার করিয়াছিলেন, এবারও তিনি সেই ভূতের বিচার আরম্ভ করিলেন। বিচারকালে কেবল এইরূপ সাক্ষ্য গৃহীত হইল যে, এই ব্যক্তিই হানিফ খাঁ, ইহারই প্রতি পূর্ব্বে চরমদণ্ডের আদেশ হয়। এই সমস্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়া জজসাহেব এই আদেশ প্রদান করেন যে, পূর্ব্ব মকর্দ্দমার বিচারে উহার প্রতি যে দণ্ডের হুকুম হইয়াছিল, সেই দণ্ডই বলবতী থাকিবে, ফাঁসি কাঠে ঝুলাইয়া উহাকে এ জগত হইতে পর-জগতে প্রেরণ করা হইরে।
কাঠরার ভিতর হইতে বাহির করিয়া লইবার সময় জজসাহেব হানিফ খাঁকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আমি তোমাকে একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
উত্তরে হানিফ খাঁ কহিল, আমি কেন আপনার বাড়ীতে ডাকাইতি করিয়াছিলাম, তাহাই জানিতে চাহেন কি?
জজসাহেব কহিলেন,—হাঁ।
হানিফ খাঁ কহিল, আপনি বিচারকালে আপনার পূর্ণ ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তাই আমিও আমার পূর্ণ ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করিতে আপনার বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া পাথেয় স্বরূপ যাহা কিছু পাইয়াছিলাম, তাহাই লইয়া প্রত্যাগমন করি।
জজ সাহেব শুনিয়া হাসিলেন।
তাহার দলের অপরাপর যে সকল ডাকাইত ধৃত হইয়াছিল, বিচারে তাহারা যথোপযুক্ত দণ্ড প্রাপ্ত হয়।
হানিফ খাঁর ফাঁসি হইবে, এবার দেশীয় জল্লাদকে বিশ্বাস না করিয়া ইংরাজ জল্লাদের দ্বারা জেলার সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর সম্মুখে ঐ কার্য্য সম্পন্ন করা হয়।
সেই সময় হইতে ঐ প্রদেশে কিছুদিন আর ডাকাইতির কথা শুনিতে পাওয়া যায় নাই।
সমাপ্ত।