এই ঘটনার প্রায় পনের দিবস পরে, সদর হইতে প্রায় দশক্রোশ ব্যবধানে একখানি ক্ষুদ্র পল্লিগ্রামে একটী ডাকাইতি হয়। যাহার বাড়ীতে ডাকাত পড়িয়াছিল, তাহার বাড়ীতে ইতিপূর্বে আর একবার ডাকাইতি হইয়াছিল। হানিফ খাঁ তাহার দল-বলের সহিত ঐ ডাকাইতি করিয়াছিল। যে সময় হানিফ খাঁ ধৃত হইয়া বিচারার্থ প্রেরিত হয়, সেই সময় তিনি হানিফ খাঁকে সনাক্ত করিয়াছিলেন ও বিচারকালে উভয় আদালতে তিনি তাহার বিপক্ষে সাক্ষ্যও প্রদান করিয়াছিলেন।
বর্ত্তমান ডাকাইতির অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত যখন পুলিস-কর্ম্মচারীগণ আগমন করেন, সেই সময় গৃহস্বামী যেরূপ এজাহার দিয়াছিলেন, অনুসন্ধানকারী পুলিস-কর্ম্মচারী তাহা তাঁহার ডাইরিভুক্ত করিয়া লন। তিনি এই কথা বলিয়াছিলেন যে, রাত্রি প্রায় তিন প্রহরের সময় যখন তাঁহারা সকলে নিদ্রিত ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ তাঁহার বাড়ীতে ডাকাইত পড়ে, ডাকাইতের সংখ্যা প্রায় ৫০ জনের কম নহে। তাহাদিগের মধ্যে তিনি হানিফ খাঁকে দেখিয়া নিতান্ত বিস্মিত হন, ভাবেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়াও ডাকাইতি পরিত্যাগ করে নাই। যখন ভূতে ডাকাইতি করিতে আসিয়াছে, তখন তাহাদিগকে বাধা দেওয়া কর্ত্তব্য নহে; এই ভাবিয়া তিনি খিড়্কি দরজা খুলিয়া সপরিবারে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া বাড়ীর সংলগ্ন একটী জঙ্গলের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করেন। ডাকাইতগণ নির্ব্বিবাদে ডাকাইতি করিয়া তাঁহার যথাসর্ব্বস্ব লইয়া প্রস্থান করে।
অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী বাদীর এজাহারের এই অংশটুকু যদিও তাঁহার ডাইরিভুক্ত করিয়াছিলেন, কিন্তু ভূতের দ্বারা যে ডাকাইতি হইয়াছে, এ কথা তিনি আদৌ বিশ্বাস করেন নাই; তিনি এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন যে, যাঁহার বাড়ীতে ডাকাইতি হইয়াছে, তাঁহার বাড়ীতে হানিফ খাঁ ইতিপূর্ব্বে আর একবার ডাকাইতি করিয়াছিল, হানিফ খাঁর মকর্দ্দমায় তিনি সাক্ষ্য প্রদান করেন। এখন হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে, এই কথাও তিনি শুনিয়াছিলেন, ও ঐ বিষয় মনে মনে আন্দোলন করিতে থাকেন। সুতরাং অন্ধকার রাত্রে ডাকাইতি করিবার সময় তিনি তাহাদিগকে দেখিয়া হতজ্ঞান হইয়া পড়েন ও বিবেচনা করেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া এই ডাকাইতি করিতেছে। যে ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে, তাহার দ্বারা এই কার্য্য কিরূপে সম্ভবপর হইতে পারে?
পুলিস-কর্ম্মচারীগণ এই মকর্দ্দমার অনেক অনুসন্ধান করিলেন, সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া অনেককে ধরিলেন, কিন্তু প্রকৃত আসামীর একজনও ধড়া পড়িল না বা এই মকর্দ্দমার কোনরূপ কিনারাও হইল না।
এই ঘটনার পর ঐ গ্রামে এক এক করিয়া আরও তিন চারিটী ডাকাইতি হইয়া গেল; কিন্তু ঐ সকল মকর্দ্দমায় হানিফ খাঁর নাম উল্লেখ হইল না বা হানিফ খাঁর ভূতকে যে আর কেহ দেখিয়াছে, এ কথাও কেহ বলিল না।
পুলিস নিয়মিতরূপে এই সকল ঘটনার অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু ইহার একটীরও কিনারা করিতে সমর্থ হইলেন না।
এইরূপে আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। ঐ গ্রামের লোক-জন ক্রমে ক্রমে হানিফ খাঁকে বা তাহার ভূতকে ভুলিয়া যাইতে লাগিল।
হানিফ খাঁর মৃতদেহ পুনঃ প্রাপ্ত হইবার আশায় জেলের ও পুলিসের কর্ম্মচারীগণ অনেক অনুসন্ধান করিয়াছিলেন এবং বিশেষ পারিতোষিক প্রদত্ত হইবে এরূপও ঘোষিত হইয়াছিল, কিন্তু কোনরূপেই ঐ মৃতদেহের কোনরূপ সন্ধান হয় নাই।
এইরূপে আরও কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর, সেই জেলার প্রধান পুলিস কর্ম্মচারী একখানি পত্র পাইলেন। যে জজ সাহেব হানিফ খাঁর মকর্দ্দমার চূড়ান্ত বিচার করিয়া তাহাকে প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, ঐ পত্রখানি তাঁহারই লিখিত। ইহার সার মর্ম্ম এই।—
“গত রাত্রে আমার বাড়ীতে একটী ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছে। রাত্রিকালে আমি আমার ঘরে একাকী শয়ন করিয়াছিলাম, নিকটেই একটী আলো অল্প অল্প জ্বলিতেছিল, সেই সময় হঠাৎ আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়, আমি চক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখি, দুই জন লোক আমার ঘরে প্রবেশ করিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে যে অগ্রে ছিল, তাহাকে দেখিবা মাত্রই আমি চিনিতে পারি, সে হানিফ খাঁ। তাহার হস্তে একখানি তরবারি ছিল, সে আমাকে হত্যা করিবার মানসেই যে আমার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এই অবস্থা দেখিয়াই আমার মনে অতিশয় ভয় হইল, আমি নিমেষ মধ্যে আলোটী নিভাইয়া দিয়া একেবারে ঘরটী অন্ধকার করিয়া ফেলিলাম ও আমার পালঙ্কের অপর পার্শ্ব দিয়া অবতরণ পূর্ব্বক পালঙ্কের নিম্ন দিয়া ক্রমে গোছলখানায় উপস্থিত হইলাম ও উহার মধ্য দিয়া অন্ধকারে আপন দেহ লুকাইয়া বাগানের ভিতর প্রবেশ করিলাম। ক্রমে উহার এক প্রান্তে গমন করিয়া কতকগুলি লতা-পাতার মধ্যে লুকাইয়া রহিলাম। আমি ঘর হইতে বহির্গত হইবার পরই আর এক ব্যক্তি মশাল হস্তে ঐ ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল ও উহারা আমার অনুসন্ধানও করিয়াছিল, কিন্তু আমাকে না পাইয়া উহারা ও উহাদিগের অনুচর যাহারা বাহিরে ছিল, তাহারা আমার গৃহস্থিত-দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে। সেই সময় আমার পরিবারবর্গ ঘরে না থাকায় অলঙ্কার-পত্র ও বহুমূল্য দ্রব্যাদি বিশেষ কিছু ঘরে ছিল না, কাজেই তৈজসপত্র বা বস্ত্রাদি যাহা কিছু সম্মুখে পাইল, তাহাই লইয়া প্রস্থান করিল। মূল্যবান দ্রব্যের মধ্যে একটী সোনার ঘড়ি, চেন, চেনে সংলগ্ন একখানি মোহর, একটী আংটী ও কয়েকখানি রূপার বাসন অপহৃত হইয়াছে। উহারা যখন মশালের আলো জ্বালিয়া বাহির হইয়া যায়, তখন আমি উহাদিগের অনেককে উত্তমরূপে দেখিয়াছি, বোধ হয় চিনিলেও চিনিতে পারি। উহাদিগের মধ্যে আমি হানিফ খাঁর মূর্ত্তি স্পষ্ট দেখিয়াছি। সেই ঐ দলের দলপতির কার্য্যে নিযুক্ত ছিল, কিন্তু আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না যে, যে ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া হইয়াছে, সেই ব্যক্তি পুনরায় কিরূপে আগমন করিল? ভূত-প্রেতের কথা আমি কখন বিশ্বাস করি নাই, কিন্তু হানিফ খাঁকে দেখিয়া আমি কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার বাড়ীতে যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহাই আপনাকে লিখিলাম, এ সম্বন্ধে যদি কোনরূপ অনুসন্ধান করা আবশ্যক বিবেচনা করেন, করিবেন। আমি যাহাকে দেখিয়া হানিফ খাঁ বলিয়া চিনিতে পারিয়াছি, সে প্রকৃত হানিফ খাঁই হউক বা তাহার ভূতই হউক, অথবা হানিফ খাঁর বেশধারী অপর কোন ছদ্মবেশী পুরুষই হউক, সে যে আমাকে হত্যা করিতে আসিয়াছিল, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই।”
প্রধান পুলিস-কর্ম্মচারী সাহেব এই পত্র পাইয়া আর ক্ষণমাত্র স্থির থাকিতে পারিলেন না, তখনই তাঁহার অধীনস্থ উপযুক্ত পুলিস-কর্ম্মচারীগণকে সঙ্গে লইয়া এই ঘটনার অনুসন্ধানে গমন করিলেন।
ঘটনাস্থলে গমন করিয়া জজ সাহেবের বাড়ীর অবস্থা স্বচক্ষে দেখিলেন। দেখিলেন, যে, সেই বাড়ীতে প্রকৃতই ডাকাইতি হইয়া গিয়াছে। সেই বাড়ীর নিকটে অপর কোন লোকের আবাসস্থান ছিল না। জেলায় সাহেবপাড়ায় যেরূপ বাঙ্লায় সাহেবগণ বাস করিয়া থাকেন, ইহাও সেই প্রকারের বাঙ্লা, ময়দানের মধ্যে স্থাপিত। সুতরাং ডাকাইতি হইবার সময় পাড়ার লোকের কোনরূপ সাহায্য পাইবার উপায় নাই। ভরসার মধ্যে কেবল ভৃত্যগণ, তাহার মধ্যেও অনেকেই রাত্রিকালে সেই স্থানে থাকে না, পাড়ার ভিতর প্রায় সকলেরই থাকিবার স্থান আছে, রাত্রিকালে তাহারা সেই স্থানে গমন করিয়া থাকে ও পরদিবস প্রত্যূষে আপনাপন কার্য্যে উপস্থিত হয়।
সুতরাং নিকটবর্ত্তী কোন লোক-জনের নিকট হইতে বিশেষ কোনরূপ অবস্থা তাঁহারা অবগত হইতে পারিলেন না। কেবল মাত্র একজন চৌকিদার কহিল, সে যখন চৌকি দিতে বাহির হয়, সেই সময় জজ সাহেবের বাড়ীর দিকে মশালের আলো দেখিয়া ও লোকের কলরব শুনিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারে, জজ সাহেবের বাড়ীতে ডাকাইত পড়িয়াছে। যদি সে কোনরূপে সাহায্য করতে পারে, এই ভাবিয়া, সে সেই দিকে আসিতে থাকে, পথে দেখিতে পায়, ডাকাইতগণ ডাকাতি করিয়া সেই দিকেই ফিরিয়া আসিতেছে। সে একাকী, সুতরাং কোনরূপ উহাদিগের প্রতিবন্ধক না হইয়া লুক্কাইত ভাবে রাস্তার একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হয়। দস্যুগণ তাহাকে অতিক্রম করিয়া গমন করিবার পর সেও দুর হইতে তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করে, কিন্তু কিছুদূর গমন করিবার পরই উহারা তাহার দৃষ্টিপথের অতীত হইয়া চলিয়া যায়।
ঐ চৌকিদার আরও বলিয়াছিল যে, সে হানিফ খাঁকে উত্তমরূপে চিনে। সে তাহাকে ঐ দলের সঙ্গে দেখিয়াছিল। ডাকাইতের দল দেখিয়া তাহার যত ভয় না হয়, ভূত দেখিয়া তাহার অতিশয় ভয় হয়, কারণ সে শুনিয়াছিল, হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে। ভূত দেখিয়া ও ভূতের ভয়ে অতিশয় ভীত হইয়াছিল বলিয়াই, সে সেই দলের সম্পূর্ণরূপ অনুসরণ করিতে পারে নাই। সে আরও বলিয়াছিল, ঐ ভূতের দল একটী বাঁশবাগানের নিকট গমন করিবার পর কোথায় মিশিয়া গেল, আর সে তাহাদিগকে দেখিতে পায় নাই। তাহার বিশ্বাস, ঐ দলের সকলেই ভূত, উহারা বাঁশ-বাগানের ভিতর গিয়াই অন্তর্ধান হয়।