এই সমস্ত সংবাদ কর্ম্মচারীকে প্রদান করিয়া আবেদ আলি, তাঁহার পরামর্শমত পুনরায় সেই স্থান পরিত্যাগ করিল। এবার তিনি তাহাকে বলিয়া দিলেন, যেরূপে হয়, ঐ ভূতের বাসস্থান স্থির করিয়া আসিবে।
এক সপ্তাহ পর, সে পুনরায় প্রত্যাগমন করিল ও কহিল, এবার সেই দলপতি ভূতের বাসস্থানের সন্ধান পাইয়াছি, যে জঙ্গলের ভিতর তাহার সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হয়, সেই জঙ্গলের মধ্যেই তাহার বাস। তবে তাহার বাসস্থান নিজ চক্ষে না দেখিলেও বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইয়াছি।
আবেদ আলির কথা শুনিয়া তিনি সমস্ত অবস্থা তাঁহার ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীকে বলিলেন। পরিশেষে ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, যত লোক আবশ্যক, তত লোক সংগ্রহ করিয়া অধিক রাত্রে ঐ জঙ্গল বেষ্টন করা হইবে। অতি প্রত্যূষেই সকলে চতুর্দ্দিক হইতে জঙ্গলের দিকে অগ্রসর হইতে থাকিবে। যে সকল লোক ঐ কার্য্যে নিযুক্ত হইবে, সকলেই পুলিসের পোষাক পরিয়া ঐ কার্য্যে নিযুক্ত হইবে; কারণ পুলিসের লোক ব্যতীত যে কোন ব্যক্তিকে উহার ভিতর পাওয়া যাইবে, তাহাকেই ধৃত ও অবরুদ্ধ করা হইবে।
এইরূপ পরামর্শ স্থির হইলে, নানাস্থান হইতে নানা পুলিস-কর্ম্মচারী ও পুলিস-প্রহরী আনীত হইল। জেলার মধ্যস্থিত যে কোন গ্রামে ও থানায় যে কোন পুলিস কর্ম্মচারী ও কনষ্টেবল ছিল, সকলেই নির্দ্দিষ্ট দিনে সদরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তৎব্যতীত নিকটবর্ত্তী জেলা সকল হইতেও অনেক পুলিসের আগমন হইল। যেস্থান হইতে যতগুলি ইংরাজ কর্ম্মচারীর সেই স্থানে উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা, তাঁহারাও আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। আবেদ আলি পূর্ব্বেই সেই স্থান গোপনে দেখাইয়া দিয়াছিল, ঐ কয়েকজন কর্ম্মচারী গুপ্তবেশে সেই স্থানে গমন করিয়া ঐ জঙ্গল ও পুষ্করিণীর অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া লইলেন।
নির্দ্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার পরই সমস্ত পুলিস-কর্ম্মচারী সদর হইতে বাহির হইয়া আপন গন্তব্য স্থানে গমন করিতে লাগিলেন। যখন তাঁহারা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন রাত্রি প্রায় ৩টা বাজিয়া গিয়াছিল। সেই সময় হইতেই তাঁহারা ঐ জঙ্গল ও পুষ্করিণীর চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিতে আরম্ভ করিলেন। সকলের আপনাপন স্থান অধিকার করিতে প্রায় চারিটা বাজিয়া গেল। পাঁচটা বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দ্দিক হইতে সকলে ক্রমে ক্রমে সেই জঙ্গলের ভিতর অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তিন চারি হস্ত অন্তর এক এক জন লোক স্থাপিত করা হইয়াছিল, উহারা যাহাতে আপন আপন কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করে, তাহা দেখিবার জন্য, প্রত্যেক দশজন কনষ্টবলের উপর একজন করিয়া দেশীয় কর্ম্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিল। তাঁহাদিগের উপর এক একজন ইংরাজ কর্ম্মচারী। তৎকার্য্যে যতগুলি লোক নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সকলেই সশস্ত্র। যিনি যে অস্ত্র উত্তমরূপে ব্যবহার করিতে পারিতেন, তাঁহাকে তাহাই প্রদান করা হইয়াছিল। কনষ্টেবলগণ লাঠি লইয়াছিল, কর্ম্মচারীদিগকে তরবারি, পিস্তল ও বন্দুক প্রদান করা হইয়াছিল।
এইরূপে সকলে সেই জঙ্গল ভেদ করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। ক্রমে ব্যাঘ্রশার্দ্দূলাদি ভীষণ বন্যজন্তুর সহিত সাক্ষাৎ হইল। উহাদের মধ্যে কেহ বা তাহাদের হস্তে নিধন প্রাপ্ত হইল, কেহ বা পলায়ন করিল।
ঐ জঙ্গলের প্রায় মধ্যস্থলে উপনীত হইলে একটী বহু পুরাতন পুষ্করিণীর ধারে একখানি ক্ষুদ্র কুটীর দেখা গেল। চারিজন ইংরাজ-কর্ম্মচারী বন্দুক হস্তে ঐ কুটীরের নিকট গমন করিলেন। দেখিলেন, ঐ কুটীরখানি দুই অংশে বিভক্ত। এক অংশে তিনজন লোক, অপর অংশে একটী পুরুষ ও একটী স্ত্রীলোক। উহাদিগের নিকট অস্ত্র শস্ত্র থাকিলেও উহারা কিন্তু কোনরূপ প্রতিবন্ধকতাচরণ করিল না; বোধ হয়, অস্ত্রধারী অনেক লোককে দেখিয়া ও সহজে তাঁহাদের হস্ত হইতে পলায়ন করিবার আশা নাই ভাবিয়া, উহারা সহজেই আত্ম সমর্পণ করিল।
যে তিনজন লোককে ঐ কুটীরের এক অংশে পাওয়া গিয়াছিল, তাহাদিগকে দলস্থ কেহই চিনিতে পারিল না, কিন্তু স্ত্রীলোকটীর সহিত যাহাকে তথায় পাওয়া গিয়াছিল, একজন কর্ম্মচারী তাহাকে চিনিতে পারিলেন। তিনি কহিলেন, আমার যদি ভ্রম না হইয়া থাকে, যদি হানিফ খাঁ এখনও জীবিত থাকে, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি, যে হানিফ খাঁর ফাঁসি হইয়াছিল, এ সেই হানিফ খাঁ ভিন্ন আর কেহই নহে; তবে সে যদি মরিয়া ভূত হইয়া থাকে, তাহা হইলেও ইহার আকৃতির সহিত হানিফ খাঁর আকৃতির কিছুমাত্র প্রভেদ নাই।
সেই সময় ঐ সকল লোককে কর্ম্মচারীগণ দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিলেন কিন্তু কেহই তাঁহাদিগের কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না, মাত্র একজন কহিল, আমাদিগকে এখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না, যেখানে লইয়া যাইতে চাহেন, সেই স্থানে লইয়া চলুন, তথায় আপনাদের সকল কথার উত্তর পাইবেন।
পরে ঐ জঙ্গলটী কর্ম্মচারীগণ উত্তমরূপে দেখিলেন, ঐ কয়জন ব্যতীত অপর কোন লোককে আর পাওয়া গেল না। যে যে স্থানে সন্দেহ হল, সেই সেই স্থান খোদিত হইল। পুষ্করিণীর ভিতর যতদূর সম্ভব অনুসন্ধান করা হইল, কেবল কতকগুলি পিতল কাঁসার বাসন ব্যতীত আর কিছুই পাওয়া গেল না। ঐ কুটীর ও উহার নিকটবর্ত্তী স্থান সকল উত্তমরূপে খোদিত করিয়াও কয়েকখানি সোণা রূপার অলঙ্কার ও সামান্য কয়েকটী মুদ্রা ব্যতীত বহুমূল্য দ্রব্য কিছুই পাওয়া গেল না, তবে বন্দুক, তরবারি, লাঠি, সড়কি প্রভৃতি অস্ত্র শস্ত্র ঐ কুঠিরের একপ্রান্তে অনেক পাওয়া গিয়াছিল। ঐ সমস্ত দ্রব্যের সহিত যে পাঁচজন ধৃত হইয়াছিল, তাহারা জেলার সদর থানায় আনীত হইল।
অলঙ্কার প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছিল সে সমস্তই যে ডাকাতি করিয়া প্রাপ্ত, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ রহিল না, ক্রমে ক্রমে ঐ সকল দ্রব্যের ফরিয়াদিও বাহির হইয়া পড়িল।
যে সকল ডাকাতের নাম ও ঠিকানা আবেদ আলি পূর্ব্বে বলিয়া দিয়াছিল, তাহারাও ক্রমে ক্রমে আপনাপন বাসস্থানে ধৃত হইতে লাগিল ও তাহাদিগের নিকট হইতে কিছু কিছু ডাকাতির দ্রব্যও পাওয়া গেল।
যে সকল ব্যক্তি হানিফ খাঁকে উত্তমরূপে চিনিত, তাঁহাদের একে একে সকলকেই আনা হইল, সকলেই হানিফ খাঁকে চিনিতে পারিলেন কিন্তু কেহই সহজে বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না যে, ঐ ব্যক্তিই প্রকৃত হানিফ খাঁ। তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকেই কহিলেন, যে ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে, সে আবার বাঁচিয়া আসিবে কিরূপে? এ প্রকৃত হানিফ খাঁ নহে, সে মরিয়া ভূত হইয়াছে, এ সেই ভূত।