আজ জেলার জজসাহেবের আদালতে লোকের জায়গা হইতেছে না, এজলাস-ঘরটী এরূপ লোকারণ্য হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার মধ্যে প্রবেশ করা কাহার সাধ্য। প্রহরীগণ কিছুতেই লোকনিবারণ করিতে পারিতেছেনা।
আজ আদালত-গৃহ এরূপ লোকে লোকারণ্য কেন? সেই জেলার প্রসিদ্ধ দস্যু-সর্দ্দার হানিফ্ খাঁর আজ বিচারের শেষ দিন। জজসাহেব তাহার মকর্দ্দমার প্রমাণ প্রয়োগ পূর্ব্বে শুনিয়াছিলেন, আজ সেই মকর্দ্দমার শেষ হুকুম প্রদান করিবেন।
হানিফ্ খাঁ সেই প্রদেশীয় একজন অতি প্রসিদ্ধ ডাকাইত সর্দ্দার। পুলিস কর্ম্মচারীগণ তাহার দলস্থিত অনেক দস্যুকে অনেকবার ধরিয়াছেন, অনেক দস্যুকে অনেকবার জেলে দিয়াছেন, কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও হানিফ্ খাঁকে কয়েক বৎসর পর্য্যন্ত ধরিতে পারেন নাই। তাহার দলস্থিত লোক ধরা পড়িয়াছে ও জেলে গিয়াছে সত্য, কিন্তু এক দিবসের জন্য তার দল ভগ্ন হয় নাই, অপর লোক সংগৃহীত হইয়া সেই দল পরিপুষ্ট হইয়াছে। গত চারি পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত ঐ প্রদেশে যত ডাকাইতি হইয়াছে, ডাকাইতির সঙ্গে সঙ্গে যতগুলি খুন হইয়াছে, তাহার প্রায় সমস্তই হানিফ খাঁর দলের দস্যুদিগের দ্বারা হইয়াছে, কিন্তু হানিফ খাঁ ধৃত হয় নাই। হানিফ খাঁর বিরুদ্ধে ডাকাইতি ও খুনি মকর্দ্দমার প্রমাণও অনেক সময় সংগৃহীত হইয়াছে সত্য, কিন্তু বিশেষ চেষ্টা করিয়াও কেহ তাহাকে ধরিতে পারে নাই। পুলিস কর্ম্মচারীগণ তাহাকে ধরিবার জন্য যে সকল যত্ন ও উদ্যম করিয়াছিলেন, তাহার সমস্তই ব্যর্থ হইয়াছে।
ইহাকে ধরিবার জন্য গবর্ণমেন্টের অনেক অর্থ ব্যয়িত হইয়াছিল ও অনেক পুরস্কার ঘোষিত করা হইয়াছিল, কিন্তু সে সময়ে হানিফ্ খাঁ কোনরূপে ধৃত হয় নাই। সম্প্রতি তাহারই দলের একটী লোক কোন কারণ বশতঃ তাহার উপর বিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হয় ও জনৈক পুলিস কর্ম্মচারীকে সংবাদ দিয়া নিদ্রা যাইবার কালীন হানিফকে ধরাইয়া দেয়। নিম্ন আদালতে প্রথম তাহার মকর্দ্দমার শুনানি হয়, পরিশেষে তাহার চূড়ান্ত বিচার হয়। পাঁচজন জুরির সাহায্যে জজ সাহেব এই মকর্দ্দমার বিচার করেন। বিচারক জজ সেই সময় একজন এদেশীয় ছিলেন।
জজ সাহেব সেই দিবস বিচারাসন গ্রহণ করিয়া অপরাপর দুই একটী সামান্য কার্য্য সম্পন্ন করিলেন, পরে হানিফ্ খাঁর মকর্দ্দমা ডাকিলেন। জেলের একজন প্রধান কর্ম্মচারী কয়েকজন পুলিশ-প্রহরীর সাহায্যে আসামীকে আনিয়া কাঠগড়ার ভিতর প্রবেশ করাইয়া দিলেন। বিচারালয় একেবারে নিস্তব্ধ হইল। জজসাহেব আসামীর দিকে লক্ষ্য করিয়া সজলনেত্রে ও ভগ্নকণ্ঠে কহিলেন, “হানিফ খাঁ! জুরিগণ নিরপেক্ষ ভাবে তোমার মকর্দ্দমার বিচার করিয়া ঠিক ন্যায়সঙ্গত ও যথাযথ অভিমত প্রকাশ করিয়া তোমাকে ডাকাইতি ও খুনি মকর্দ্দমায় দোষী সাব্যস্ত করিয়াছেন। আমিও তাঁহাদিগের মতের সম্পূর্ণ পোষকতা করিয়া আমার কর্ত্তব্য-কর্ম্মের অনুরোধে বাধ্য হইয়া তোমাকে আইনের চরম দণ্ডে দণ্ডিত করিতেছি। তোমার উপর যতগুলি ডাকাইতি ও নরহত্যার প্রমাণ হইয়াছে, একব্যক্তি দ্বারা যে এতগুলি গুরুতর অপরাধ ঘটিতে পারে, তাহা আমি ইতিপূর্ব্বে কখন বিশ্বাস করি নাই। তোমার উপর বিচারালয়ের এই আদেশ হইতেছে যে, “যে পর্য্যন্ত তোমার প্রাণবায়ু বহির্গত না হয়, সেই পর্য্যন্ত তোমার গলায় রজ্জু বেষ্টিত করিয়া তোমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়া রাখা হইবে।”
হানিফ খাঁ জজ সাহেবের আদেশ ধীরভাবে শ্রবণ করিয়া, একটু হাসিল ও জজ সাহেবকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আপনি হিন্দু-বিচারক, আপনার ক্ষমতায় যতদূর কুলায়, তাহার শেষ পর্য্যন্ত আপনি দেখাইলেন, কিন্তু শুনিয়াছি, আপনাদিগের শাস্ত্রে ইহা কহে যে, মানুষ মরে না, তাহার আত্মা পুরাতন দেহ পরিত্যাগ করে মাত্র, ইহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে জজ সাহেব, আপনি জানিবেন, এক দিবস আপনার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে, আপনার ক্ষমতা আপনি দেখাইলেন, আর সে দিন আমার ক্ষমতা আপনি দেখিবেন।”
হানিফ খাঁর কথা শেষ হইতে না হইতে জেলের সেই কর্ম্মচারী সাহেব তাহাকে আর সেইস্থানে থাকিতে দিলেন না, পুলিস-প্রহরীর সাহায্যে তাহাকে কাঠগড়া হইতে বাহির করিয়া লইয়া গেলেন।
হানিফ খাঁকে বিচার-গৃহ হইতে বাহির করিয়া লইয়া যাইবার পর, যে সকল দর্শক ঐ ঘর পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহারাও একে একে ঐ ঘর হইতে বহির্গত হইয়া গেল, কিন্তু উহাদিগের মধ্যে কাহাকেও কোনরূপে অসন্তোষ প্রকাশ করিতে দেখা গেল না; অধিকন্তু অনেকেই কহিল, হানিফ খাঁ যেরূপ কার্য্য এ পর্য্যন্ত করিয়া আসিতেছিল, আজ তাহার উপযুক্ত ফল সে পাইল। আজ হইতে আমাদিগের দেশ ঠাণ্ডা হইবে, ডাকাইতি একেবারেই বন্ধ হইয়া যাইবে।
কেহ কহিল, “পাপ করিয়া কত দিন বাঁচা যায়, উপরে একজন আছেন, তাঁহার নিকট হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ নহে।”
এইরূপে নানা লোক নানা কথা বলিতে বলিতে আপনাপন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল। দেখিতে দেখিতে যে স্থান লোকে লোকারণ্য ছিল, সেই স্থান একেবারে প্রায় জনশূন্য হইয়া পড়িল।